ভূমিকা
‘দূর জীবনের পার হতে আমি আমার যে পাখিডাকা, তেলকুচো ফুল ফোটা, ছায়াভরা মাটির ভিটেকে অভিনন্দন করে শুধু জানাতে চাই, – ভুলিনি! ভুলিনি ! যেখানেই থাকি ভুলিনি ! — তোমার কথাই লিখে যাব—সুদীর্ঘ অনাগত দিনের বিচিত্র সুর সংযোগের মধ্যে তোমার মেঠো এক তারার উদার, অনাহত ঝংকারটুকু যেন অক্ষুণ্ণ থাকে।’—শতাব্দী পেরিয়ে চিরকিশোর বিভূতিভূষণের গ্রামের উদ্দেশ্যে লেখা দিনলিপির কথা আজও আমাদের মনে পড়ে। সেই সঙ্গে আমাদের স্মৃতিপটে স্মরণীয় হয়ে থাকেন প্রকৃতির শিল্পী বিভূতিভূষণ। তাই তিনি আমার প্রিয় বাংলাভাষার লেখক।
আবির্ভাব
বিভূতিভূষণ শরৎ পরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্যে উজ্জ্বল নক্ষত্র। ‘পথের পাঁচালী’র লেখক বিভূতিভূষণ পাঠকের কাছে বিশেষ সমাদৃত। এই সমাদর তাঁর নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যের জন্যই। তার কারণ তিনি দারিদ্র্যের ছবি দেখিয়েছেন, কিন্তু তা নিয়ে বিদ্রোহের সুর তোলেন নি। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের ছাটখাটো সুখ, দুঃখ, তার লীলাচাঞ্চল্য, দুঃখের মধ্যে আনন্দের অভিব্যক্তিকে তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর গল্প-উপন্যাসে। এদিক থেকে তাঁর গ্রন্থগুলি ‘গার্হস্থ্য উপন্যাস’। সেই সঙ্গে প্রকৃতিকে জীবনের উপাদানরূপে চিহ্নিত করা রবীন্দ্রপূর্ব যুগে অভাবিত ছিল—তাও বিভূতিভূষণের বিশেষ কৃতিত্ব ।
বিভূতিভূষণের দৃষ্টিভঙ্গি
বিভূতিভূষণ তাঁর শিল্পীমানসের দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন—
“যে জগৎকে আমরা প্রতিদিনের কাজকর্মে হাটে-ঘাটে হাতের কাছে পাইতেছি জীবন তাহা নয়, এই কর্মব্যস্ত অগভীর একঘেয়ে জীবনের পিছনে একটি সুন্দর পরিপূর্ণ, আনন্দভরা সৌম্য জীবন লুকানো আছে—সে এক শাশ্বত রহস্যভরা গহন গভীর জীবন-মন্দাকিনী, যাহার গতি কল্প হইতে কল্পান্তরে; দুঃখে তাহা করিয়াছে অমৃতত্বের পাথেয়, অশ্রুকে করিয়াছে অনন্ত জীবনের উৎসধারা।”
তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেছেন—
“বাংলাদেশের সাহিত্যের উপাদান বাংলার নরনারী, তাদের দুঃখ-দারিদ্র্যময় জীবন, তাদের আশা-নিরাশা, হাসি কান্না-পুলক—বহির্জগতের সঙ্গে তাদের রচিত ক্ষুদ্র জগৎগুলি ঘাত-প্রতিঘাত, বাংলার ঋতুচক্র, বাংলার সন্ধ্যা সকাল, আকাশ-বাতাস, ফুল-ফল, বাঁশবনের, আমবাগানেরনিভৃত ছায়ায় ঝরা সজনে ফুল বিছানো পথের ধারে যেসব জীবন অখ্যাতির আড়ালে আত্মগোপন করে আছে—তাদের কথাই বলতে হবে। তাদের সে গোপন সুখদুঃখকে রূপ দিতে হবে।”
মানুষ, প্রকৃতি, ঈশ্বর——এই তিন মিলে গড়ে উঠেছে বিভূতিভূষণের সাহিত্যলোক যা রবীন্দ্র-পূর্ব যুগে পাওয়া যায় না।
ব্যক্তিজীবন
বিভূতিভূষণের কথাসাহিত্যের উপাদান ও বিষয়বস্তু খুব সাধারণ, মোটেই চমকপ্রদ নয়। তাঁর ব্যক্তিজীবনও সাধারণ, বৈচিত্রহীন। দারিদ্র্যের সঙ্গে তিনি ঘর করেছিলেন। কেবল জীবনের শেষ দশ বছর আর্থিক স্বচ্ছলতা পেয়েছিলেন। তাঁকে টানত ঈশ্বর আর প্রকৃতি। তাঁর বৃত্তি ছিল শিক্ষকতা—কিছুটা কলকাতায়, বেশিরভাগ গ্রামের বিদ্যালয়েই তিনি শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর প্রিয় পাঠা বস্তু ছিল : সাহিত্য, ভ্রমণবৃত্তান্ত, আকাশতত্ত্ব, জীবনবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যা, পরলোকতত্ত্ব, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা। তাঁর পিতার নাম মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী। যশোরের বনগ্রাম মহকুমার বারাকপুর গ্রামে তাঁদের বাড়ি। মহানন্দ সংস্কৃত পণ্ডিত ও কথকরূপে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর ছিল ভ্রমণের নেশা। তিনি ভবঘুরে উদাসীন প্রকৃতির লোক ছিলেন, সংসারে টান ছিল না, উপার্জনে মন ছিল না। কবিমনের অধিকারী পিতার এইসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পুত্র বিভূতিভূষণেও বর্তেছিল।
আবির্ভাবকালীন পটভূমি
১৩২৮ সালের মাঘ সংখ্যা প্রবাসীতে ‘উপেক্ষিতা’ গল্পের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিভূতিভূষণের প্রথম আবির্ভাব। এই আবির্ভাবকালীন পটভূমিকাটি বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। সে সময়ে কল্লোল পর্বের তরুণ লেখকদের রচনায় প্রথম সমরোত্তর সংশয় ও অস্থিরতা, চাঞ্চল্য ও নাগরিক মনোভাব, নেতিবাদী ও নাস্তিক দৃষ্টিভঙ্গি, রোমান্টিক বিদ্রোহ ও দেশজ সংস্কৃতির অস্বীকৃতিমূলক মনোভাব প্রাধান্য পেয়েছিল। পাঠকরা তাঁর সাহিত্যের মধ্যে খুঁজে পান পল্লীগ্রামের সৌম্য, শাশ্বত, পরিপূর্ণ জীবন ও জীবনসত্যকে যা একেবারেই স্বতন্ত্র।
পথের পাঁচালী ও বিভূতিভূষণ
‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিভূতিভূষণ পাঠক হৃদয় অধিকার করেন। রবীন্দ্র-শরৎশাসিত বাংলা কথাসাহিত্যে বিভূতিভূষণ নিজেকে সেদিন প্রথম আবির্ভাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠা থেকে তাঁকে আর কেউ বিচ্যুত করতে পারেনি। ‘পথের পাঁচালী’র বিশেষত্ব প্রকৃতিপট নির্মাণে নয়, পাঁচালীকারের অধিকতর সানুপুঙ্ক্ষ তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে। তাছাড়া পথের পাঁচালীর একমাত্রতা এবং অনন্যতা তাঁর কেন্দ্রীয় চরিত্র নির্বাচনে। তাই অপু ও দুর্গা সমসাময়িক তরঙ্গাঘাত থেকে বিচ্ছিন্ন আলাদা জগতের শিশু। ‘পথের পাঁচালী’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছেন—“বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে। ……এই গল্পে গাছপালা, পথঘাট, মেয়ে-পুরুষ, সুখ-দুঃখ সমস্তকে আমাদের আধুনিক অভিজ্ঞতার প্রাত্যহিক পরিবেষ্টনের থেকে দূরে প্রক্ষিপ্ত করে দেখানো হয়েছে। সাহিত্যে একটা নতুন জিনিস পাওয়া গেল অথচ পুরাতন পরিচিত জিনিসের মত সুস্পষ্ট।”
প্রকৃতি প্রীতি ও আরণ্যক
অন্যদিকে বিভূতিভূষণের প্রকৃতিপ্রেম, নিসর্গমুখিতা, সরল সততা আরণ্যকে প্রকাশ পেয়েছে। ‘আরণ্যক’ যত না নৈসর্গিক বিস্ময়ের গল্প, তার চেয়ে অনেক বেশি মানবীয় বাস্তবতার কাহিনি। ‘আরণ্যক’-এর কথক সত্যচরণ, ‘পথের পাঁচালী’র অপু আর এদের সৃষ্টিকর্তা বিভূতিভূষণ রূপে এক সত্তার প্রকাশ। দর্শক সত্যচরণের জীবনে অরণ্য-প্রকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে মানুষ। দিগন্তলীন মহালিখারূপের পাহাড় ও মোহনপুরা অরণ্যানীর পটভূমিতে নাঢ়াবইহারের ও লবটুলিয়ার অরণ্য প্রান্তর বিনষ্ট করে বসতি স্থাপনের কাজটি সত্যের হাতেই নিষ্পন্ন হয়েছিল। তবু এই আরণ্য প্রকৃতিকে সত্য ভালোবেসেছে, সেই সঙ্গে তার মনের মণিকোঠায় সাজানো আছে বহু চরিত্র। এরাই ‘আরণ্যক’-এর চরিত্র—ভানুমতী, মঞ্জী, কুম্ভী, মটুকনাথ, যুগলপ্রসাদ, রাজু পাঁড়ে, গনোরি তেওয়ারী, দোবরু প্রভৃতি।
উপন্যাস ও ছোটগল্প
বিভূতিভূষণের প্রকাশিত অন্য উপন্যাসগুলি হল— ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘বিপিনের সংসার’, ‘দুই বাড়ী’, ‘অনুবর্তন’, ‘দেবযান’, ‘কেদাররাজা’, ‘অথৈজল’, ‘অশনি সংকেত’ ইত্যাদি। ঊনত্রিশ বছর (১৯২২-৫০) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছোটগল্প লিখেছেন। তাঁর গল্পের বিষয় বৈচিত্র্য যথেষ্ট। তাঁর প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা ২২৪। গল্পগুচ্ছের সংখ্যা ১৯। এগুলি হল—‘মেঘমল্লার’, ‘মৌরীফুল’, ‘যাত্রাবদল’, কিন্নরদল’, ‘তালনবমী’, ‘উপলখণ্ড’, ‘বিধুমাষ্টার’, ‘ক্ষণভঙ্গুর’ ইত্যাদি। তাঁর গল্পগুলি খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যায়, কেবলমাত্র প্রকৃতি তাঁর গল্পের উপাদান নয়। মানুষই বিভূতিভূষণের গল্পলোকের প্রধান আকর্ষণ। মানুষ, প্রকৃতি, ঈশ্বর—এই তিন মিলে যে জীবনের সমগ্রতা— এই বিশ্বাস নিয়েই তাঁর গল্পগুলি রচিত।
উপসংহার
বর্তমান জীবনের এই ক্লেদাক্ত, পঙ্কিলতা, অন্যায়, বঞ্চনা ও হতাশার কলরোলের মধ্যে দাঁড়িয়ে, বিভূতিভূষণের কাছ থেকে কোন শিক্ষণীয় বিষয় কি গ্রহণ করতে পারব? যে বিভূতিভূষণ বুঝেছিলেন ভারতীয় জীবনের সমগ্রতার দিক, তার গভীর শান্ত রসের ধারা, হতাশার মধ্যে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন—তা কি বর্তমান জীবনে পাথেয় স্বরূপ নয়? কারণ বিভূতিভূষণ নিজেই বলেছেন—’গভীর রাত পর্যন্ত বড় বাসার ছাদে বসে মেঘলা রাতে কত কথা মনে আসে—আবার যদি জন্মই হয় তবে যেন ঐরকম দীনহীনের পর্ণকুটীরে অভাব-অনটনের মধ্যে, পল্লীর স্বচ্ছতোয়া গ্রাম্য নদী, গাছপালা নিবিড় মাটির গন্ধ, অপূর্ব সন্ধ্যা, মোহভরা দুপুরের মধ্যেই হয়—’। জীবনানন্দও বলেছেন—’আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালবেসে’। আর এই আমাদের জীবনের পরম শান্তির পথ, যা প্রকৃতির শিল্পী আমাদের ভাবতে শিখিয়েছেন। সেজন্য লেখক হিসেবে বিভূতিভূষণ আমার বড় প্রিয়।