বায়ুদূষণ কাকে বলে ?
ওয়ালর্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন (WHO)-এর মতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্যে ক্ষতিকর পদার্থের সমাবেশ যখন মানুষ ও তার পরিবেশের ক্ষতি করে,সেই অবস্থাকে বায়ু দূষণ (air pollution) বলে।
বিজ্ঞানী পার্কিল (১৯৭৪)-এর মতে বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত থাকা বা বায়ুমণ্ডলে নির্গত হওয়া দুষিত ধোঁয়া, গ্যাস, গন্ধ, ধোঁয়াশা, বাষ্প ইত্যাদি যে পরিমাণে ও যতক্ষণ স্থায়ী হলে মানুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদ জগতের ক্ষতি হয় বা মানুষের জীবন ও স্বাচ্ছন্দ্যে বাধা দেয়, তাকে বায়ুদূষণ বলে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, বায়ুদূষণের পরিধি ও ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি। কারণ বায়ু সবচেয়ে তাড়াতাড়ি দুষিত পদার্থকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে পারে।
বায়ুদূষণের উৎস ও কারণগুলি কী কী ?
বায়ুদূষণ নানাভাবে হতে পারে। এর মধ্যে কিছু প্রাকৃতিক কারণ আর কিছু মানুষের তৈরি করা
কারণ, যেমন-
বায়ুদূষণের প্রাকৃতিক কারণ ও উৎসসমূহ :
- অগ্ন্যুৎপাতের ফলে নিঃসৃত সালফার ডাইঅক্সাইড (SO2), কার্বন মনোঅক্সাইড (CO),হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস (HS)।
- বিভিন্ন জৈব ও অজৈব পদার্থের বিয়োজন বা পচনের ফলে সৃষ্ট গ্যাস।
- দাবানল (Wildfire), ধুলিঝড় (Dust devil)।
- ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া, ফানজাই (fungi), অ্যালজি (algae), পরাগরেণু (pollen) ইত্যাদি।
অপ্রাকৃতিক বা মানুষের তৈরি বায়ুদূষণের কারণ :
- খনি এলাকার ধুলোবালি, ধূলিকণা, শিল্পজাত ধুলি (যেমন- ফ্লাই অ্যাশ), কালিঝুলি(soot), ধোঁয়া ইত্যাদি ।
- দাড়ি কামানোর ফোম ও স্প্রে, বিমানে ব্যবহৃত এরোসল (aerosols) এবং বিভিন্ন বিষাক্ত তরল পদার্থ।
- যানবাহন ও কলকারখানা থেকে নির্গত গ্যাস, যেমন- কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, নাইট্রোজেন অক্সাইড ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ করা যায় যে হাইড্রোকার্বন ও কার্বন মনোঅক্সাইডের প্রধান উৎস হল কয়লা, পেট্রোল প্রভৃতি জ্বালানির অসম্পূর্ণ দহন।
- ব্যাপকভাবে অরণ্য ধ্বংস করার ফলে অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইড পারস্পরিক ভারসাম্যের হানি ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি।
- যুদ্ধবিগ্রহের ফলে বা পারমাণবিক চুল্লিতে দুর্ঘটনার ফলে তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণ (যেমন- ইউক্রেনে চেনোবিল পরমাণু কেন্দ্রের দুর্ঘটনা বা হিরোসিমা-নাগাসাকিতে পরমাণু বোমার ধ্বংসলীলা) ইত্যাদি।
মানুষের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব কী?
বায়ুদূষণ মানুষের ক্ষতি করে। যেমন :
- ধোঁয়াশার প্রভাবে চোখ জ্বালা করে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়।
- সালফার ডাইঅক্সাইডের প্রভাবে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। ব্রঙ্কাইটিস, যক্ষ্মা প্রভৃতি রোগ হয়। (৩) নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডের জন্য শ্বাসকষ্ট হয়। ফুসফুসের ক্ষতি হয়। নিউমোনিয়া হওয়ার আশক্ষা থাকে।
- কার্বন মনোঅক্সাইডের জন্য রক্তের অক্সিজেন সংবহন ক্ষমতা বিঘ্নিত হয়।
- বেড়াপাইরিনের (Benzopyrene Co.) জন্য ক্যানসার হয়। এখানে উল্লেখ করা দরকার রাস্তায় দেওয়ার জন্য পিচ গুলানোর সময়ে যে ধোঁয়া বেরোয়, তাতে বেজপাইরিন জাতীয় যৌগ পাওয়া যায়।
- বাতাসে ভাসমান সিসা, বালি, কালার গুঁড়ো ইত্যাদি শ্বাসনালি ও ফুসফুসের ক্ষতি করে।স্নায়ুরোগের কারণ হয়।
- কার্বন মনোঅক্সাইড (CO)-এ প্রভাবে দৃষ্টিবিভ্রম, দৃষ্টিশক্তি হানি, মাথাধরা, মাথা, মাথা ঝিমঝিম, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, রক্তের অক্সিজেন বহন ক্ষমতা কমে যাওয়া। এমনকি কার্বন মনোঅক্সাইডের প্রভাবে মৃত্যুও হতে পারে। বস্তুত CO একটি শ্বাসদূষক রক্তদূষক গ্যাস।
- কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2)-এর প্রভাবে শ্বাসকষ্ট ও শারীরিক নানা অস্বস্তি হয়। (৩) সালফার ডাইঅক্সাইড (SO.)-এর প্রভাবে শ্বাসকষ্ট, কাশি, চোখে অস্বস্তি, হৃদযন্ত্রে গণ্ডগোল, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
- নাইট্রোজেনের অক্সাইডগুলি (NO) যেমন নাইট্রিক অক্সাইড (NO), নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO)) এবং নাইট্রাস অক্সাইড (NO)-এর প্রভাবে জীবদেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতত্ত্ব (Central Nervous System) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রক্ত দূষিত হয়। ফুসফুসের ক্ষতি হয়। চোখ, নাক ও গলায় অস্বস্তি হয়। মৃত্যুও হতে পারে।
- হাইড্রোজেন সালফাইড (HS)-এর প্রভাবে মাথা ধরা, বমি ভাব, পেট খারাপ, চোখ ও গলা জ্বালা এমনকি শ্বাসকষ্টে মৃত্যু হতে পারে।
- হাইড্রোজেন ফ্লুয়োরাইড (HF) ফ্লুরোসিস (Fluorosis) নামক রোগ সৃষ্টি করে। হাত, পা,হাঁটু, শিরদাঁড়া ও গাঁটে ব্যথা হয়।
- হাইড্রোকার্বন (Hydrocarbons)-এর জন্য ফুসফুসের রোগ, শ্বাসকষ্ট এবং ক্যানসার হতে পারে।
- ওজোন (O-)-এর প্রভাবে ফুসফুসে রক্তক্ষরণ ও ক্যানসার, মাথাধরা, চোখের অসুস্থ, ব্রংকাইটিস, গ্যাসের সমস্যা ইত্যাদি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। (৯) ক্লোরিন (CI) শ্বাসকষ্ট, শ্বাসনালিতে জ্বালাভাব, চোখের সমস্যা তৈরি করে।
- ভাসমান সূক্ষ্মকণা (SPM) নাক, কান, গলা, চোখ, ফুসফুস ও মস্তিষ্কের নানারকম রোগ সৃষ্টি করে।
বায়ুদূষণের মূল উপাদানগুলি কী কী?
মূলত তিনটি উপাদানের মাত্রা বা পরিমাণের ওপর নির্ভর করে বায়ুদুষণের পরিমাণ হিসাব করা হয়। যেমন
- সালফার ডাইঅক্সাইড (SO2)
- নাইট্রোজেন অক্সাইড (NO2)
- বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম কণিকা (Suspended Particulate Matter)
মূখ্য বায়ুদূষক বা প্রাইমারি এয়ার পলিউট্যান্ট বলতে কী বোঝায়?
প্রাকৃতিক কারণে বা মানুষের বিভিন্ন কাজকর্মের মাধ্যমে সৃষ্ট যে সমস্ত বায়ুদূষক ভালো উৎস (source) থেকে সরাসরি বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তাদের মুখ্য বায়ুদূষক ( Primary Air Pollutants সংক্ষেপে PAPs) বলে। বায়ুমণ্ডলে দূষণের প্রায় ৯০% এই দুষকগুলির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। উদাহরণ- সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড, কার্বনমনোঅক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড, অধিকাংশ হাইড্রোকার্বন, বাতাসে ভাসমান মৃত কণিকা ইত্যাদি।
বায়ুদূষণ নিবারণের উপায় কী?
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করার উপায় হল :
- যন্ত্রপাতি, কলকারখানা, বা যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাসকে বাতাসে ছাড়ার আগে যান্ত্রিক উপায়ে শোধন করার বন্দোবস্ত করা হলে বায়ুদূষণ রোধ করা যায়। যেমন— মোটর গাড়ির ধোঁয়া, চিমনি দিয়ে বেরিয়ে আসা ধোঁয়া ইত্যাদির মধ্যে প্রচুর দুষিত পদার্থ থাকে। বাকি উপায়ে এই দূষিত পদার্থগুলিকে নির্গত গ্যাস থেকে আলাদা করে নিতে হবে। এই কাজের জন্য ফিলটার, সাইক্লোন সেপারেটর, ক্যাটালিটিক কনভার্টার, ইলেকট্রোস্ট্যাটিক প্রেসিপিটর প্রভৃতি যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
- উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে এমন যন্ত্রপাতি তৈরি করতে হবে বা এমন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, যার ফলে দূষিত পদার্থের উৎপাদনই কমে যাবে। ফলে যানবাহন, যন্ত্রপাতি বা কলকারখানা থেকে নির্গত গ্যাস তখন বায়ুকে বেশি দূষিত করতে পারবে না।
- এমন জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে যাতে দূষিত পদার্থ, ধোঁয়া ইত্যাদি কম উৎপন্ন হয়।