সৌরশক্তি কী ? / সৌরশক্তি কাকে বলে ?
সূর্য থেকে যে শক্তি পাওয়া যায়, তাকে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত করলে ওই বিদ্যুৎশক্তিকে সৌরশক্তি (solar energy) বলে। সৌর শক্তি পুনর্ভব, প্রবহমান, সর্বব্যাপ্ত (Ubiquitous) সম্পদ।
সৌরশক্তিকে চিরাচরিত শক্তির বিকল্প বলে মনে করা হয় কেন?
সূর্য এক প্রচণ্ড শক্তির আধার। তবে সূর্যের অসীম শক্তিকে পরিপুর্ণভাবে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করার কারিগরি জ্ঞান এখনও মানুষের আয়ত্তাধীন নয়। বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রয়াস যেদিন বাস্তব রূপ নেবে, সেদিন পৃথিবীতে জ্বালানির আর কোনো সমস্যা থাকবে না। কারণ প্রতি ঘণ্টায় সারা পৃথিবীতে যে পরিমাণ সূর্যরশ্মি পৌঁছায়, তাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করলে যে তাপশক্তি পাওয়া যাবে তা 21 × 1012 টন কয়লার সমান।
সৌরশক্তির ব্যবহার কী ?
সৌরশক্তিকে মানুষ যেভাবে কাজে লাগাতে পারে, সেগুলি হল :
- শস্য, ফলমূল, কাঠ ইত্যাদি শুকনো করতে পারে।
- শীতপ্রধান অঞ্চলে ঘর গরম রাখা ও দৈনন্দিন প্রয়োজনে গরম জলের জোগান দিতে পারে।
- সমুদ্রের জল থেকে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে লবণ উৎপাদন করতে পারে।
- রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রগুলিকে আলোকিত করা, জলসেচ দেওয়ার কাজ করতে পারে।
- সোলার কুকার দিয়ে রান্নাবান্নার কাজ করতে পারে।
সৌরশক্তি ব্যবহারের সুবিধা কী?
- সৌরশক্তি হল অসীম ও পুনর্ভব (Indefinitely renewable) সম্পদ। একই সঙ্গে সৌরশক্তি হল সুস্থায়ী বা সাসটেনেবল (sustainable ) সম্পদ।
- সৌরশক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত সোলার প্যানেলগুলির (solar panel) রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অল্প। তাছাড়া খুব বড়ো মাপের জটিল যন্ত্রপাতিও সৌরশক্তি উৎপাদনের জন্যপ্রয়োজন হয় না।
- সৌরশক্তি ব্যবহার করে জল গরম করা, রান্না করা, দূরবর্তী দ্বীপ বা জনবসতির আলোর বন্দোবস্ত করা, চিরাচরিত প্রথায় উৎপাদিত তাপবিদ্যুৎ ও জলবিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করা প্রভৃতি কাজে সৌরশক্তি খুব সুবিধাজনক। (৪) সৌরশক্তি উৎপাদনের জন্য শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, উষ্ণায়ন প্রভৃতি সমস্যাগুলি ঘটে না।
সৌরশক্তি ব্যবহারের অসুবিধা কী?
- রাত্রিবেলা সৌরশক্তি উৎপাদন করা যায় না। মেঘলা দিনেও সৌরশক্তির উৎপাদন হ্রাসপায়। এছাড়া সূর্যের পূর্ব থেকে পশ্চিমদিকে দৈনিক গতিপথের সঙ্গে সংগতি রেখে সোলার প্যানেলগুলিকে (solar panel) সবসময়ে সঠিক কোণে (angle), সূর্যের সঙ্গে মুখোমুখি স্থাপন করার সমস্যা হয়। বস্তুত, সূর্যের সঙ্গে সৌর প্যানেলের সঠিক কোণটি বজায় রাখা জরুরি। নচেৎ সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে অসুবিধা হয়।
- প্রচুর পরিমাণে সৌরশক্তি উৎ সনের প্রয়োজন হলে বিরাট এলাকা জুড়ে প্রচুর সৌরপ্যানেল বসানোর জন্য অনেক জায়গা লাগে। ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায় জমি পাওয়ার সমস্যা আছে।
- বর্তমানে প্রযুক্তি অনুসারে আগত সৌরশক্তির মাত্র 20 শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যায়।
- ভারী শিল্পের (heavy Industry) ব্যবহারের জন্য সৌরশক্তি এখনও চিরাচরিত শক্তির লাভজনক বিকল্প নয় ।
সোলার পার্ক বা সোলার ফার্ম কী ?
সোলার পার্ক (solar park) বা সোলার ফার্ম (solar firm) হল বাণিজ্যিকভাবে সৌরশক্তি উৎপাদনের জন্য বিরাট এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা ফটোভোলটিক শক্তি কেন্দ্র (Photovoltaic power station)। এখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পাওয়ার গ্রিড-এর (power grid) মারফৎ সরবরাহ করা হয়। প্রসঙ্গত, সোলার পার্ক ও সোলার ফার্ম সমার্থক শব্দ।
সৌরশক্তির উৎপাদন পরিবেশের ওপর কী প্রভাব ফেলে ?
সৌরশক্তির উৎপাদন পরিবেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে তার অনেকটাই নির্ভর করে কোন্ প্রযুক্তির সাহায্যে সৌরশক্তি উৎপাদন করা হয়; সৌরশক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত এলাকাটির ভূমিরূপ, ভূমিঢাল, জমির ব্যবহার, জমির ধরন ইত্যাদি বিষয়ের ওপর।বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে 1 মেগাওয়াট সৌরশক্তি উৎপাদনের জন্য গড়ে 35 থেকে প্রায় 165 একর জমি লাগে। PV অর্থাৎ ফটোভোল্টিক পদ্ধতি ব্যবহার করলে জমি লাগে 3.5 থেকে 10 একর এবং CSP অর্থাৎ কনসেনট্রেটিং সোলার থার্মাল প্ল্যান্টস (Concentrating Solar Thermal Plants) পদ্ধতিতে 4-0 থেকে 16.5 একর। এছাড়া ঘর-গৃহস্থালির কাজের জন্য বা অফিসের প্রয়োজনে সোলার প্যানেলগুলি ছাদে রাখা হয়।
CSP পদ্ধতিতে জলের প্রয়োজন হয় শীতল করার জন্য। প্রতি মেগাওয়াট সৌরশক্তির জন্য 2500 থেকে 3000 লিটার জল লাগে। তবে এই জল বাষ্প হয়ে নষ্ট হয় না। ফটোভোন্টিক সেল (PV cell) প্রস্তুত করার জন্য হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, সালফিউরিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অ্যাসিড প্রভৃতি রাসায়নিকের প্রয়োজন হয়, যা মানবদেহ ও পরিবেশের পক্ষে বিপদজনক।
পৃথিবীতে সৌরশক্তির বণ্টন কী সর্বত্র সমান ? পৃথিবীর সর্বত্র সূর্যরশ্মি সমানভাবে পৌঁছাতে পারে না। কারণ পৃথিবীর নিজস্ব প্রায় গোলাকার আকৃতি সূর্যরশ্মির পতন কোণের তারতম্য ঘটায়। তা ছাড়া, পাহাড়, পর্বত, মরুভূমি, সমুদ্রের অবস্থান, মেঘমুক্ত আকাশ, অরণ্য ও উদ্ভিদের চরিত্র ইত্যাদি বিভিন্ন কারণের জন্য ভূ-পৃষ্ঠে সুর্যশক্তির বণ্টন অসমান। পৃথিবীর ক্রান্তীয়মণ্ডল সৌরশক্তিতে সমৃদ্ধ।
ভারতে সৌরশক্তি উৎপাদনের অবস্থা কী ?
সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভারত পৃথিবীতে একটি অগ্রণী দেশ। বর্তমানে ভারতের সম্ভাব্য (potential) সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা 15.49 লক্ষ মেগাওয়াট। অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুমালা, পশ্চিমবঙ্গ, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাঞ্চল, জম্মু-কাশ্মীর, আন্দামান-নিকোবর ও লাক্ষাদ্বীপে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সৌরকোশ বসানো হয়েছে। সৌরশক্তি উৎপাদনে তামিলনাড়ু দেশের মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করে। এই রাজ্যের রামনাথপুরম জেলার কামুথি (Kamuthi) নামক স্থানে একটি একক সৌরশক্তি উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, যার উৎপাদন ক্ষমতা 648 মেগাওয়াট। 2017 সাল থেকে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সৌরশক্তির বাজারে পরিণত হয়েছে। ভারতের আগে রয়েছে যথাক্রমে চিন ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।